বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি 

  • ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ   
  • ১২ নভেম্বর, ২০২০ ১২:১৮

১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর বাংলাদেশ সংসদে মানবতা ও সভ্যতাবিরোধী কলঙ্কিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল আইন প্রণয়ন করা হয়। ঘোচানো হয় ২১ বছরের জাতীয় কলঙ্ক। আর আজ সেই কলঙ্কমুক্তির দিন।

আজ ১২ নভেম্বর। বাঙালি জাতির কলঙ্ক মুক্তির দিবস। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর বাংলাদেশ সংসদে মানবতা ও সভ্যতাবিরোধী কলঙ্কিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল আইন প্রণয়ন করা হয়। ঘোচানো হয় ২১ বছরের জাতীয় কলঙ্ক। আর সেই সঙ্গে সুগম হয় ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত সংঘটিত বঙ্গবন্ধু হত্যা, জাতীয় চার নেতা হত্যাসহ অসংখ্য বিচারবহির্ভূত রাজনৈতিক হত্যার বিচারের পথ।

দক্ষিণ-এশীয় রাষ্ট্রগুলো নৃশংস রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের উর্বর ভূমি। প্রতিহিংসার রাজনীতি দক্ষিণ এশিয়ায় একটি অতি স্বাভাবিক বিষয় বলেই আমরা ধরে নেই। নেতাকে হত্যার মাধ্যমে আমরা ভাবি তার দর্শনের, তার আদর্শের মৃত্যু আমরা ঘটাতে পারলাম। কিন্তু সত্যিই কি তাই? নেতা তো বেঁচে থাকেন তার কর্ম আর আদর্শের মধ্যে দিয়েই। নেতা অমর, তার ক্ষয় নেই। কিন্তু হতবাক হওয়ার মতো বিষয় হল, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে নেতা হত্যার মতো ঘটনা ঘটলেও তার তদন্ত ও বিচার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু করা হয়েছে। কোথাও বাংলাদেশের মতো ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করে বিচারের পথ বন্ধ করার মতো ন্যাক্কারজনক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। উদাহরণ রয়েছে অসংখ্য।

ভারতের স্বাধিকার আন্দোলনের নেতা এবং জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকে ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি গুলি করে হত্যা করা হয়। সে সময় তিনি নতুন দিল্লীতে রাত্রিকালীন পথসভা করছিলেন। তার হত্যাকারী নাথুরাম গডসে ছিলেন একজন হিন্দু মৌলবাদী যার সঙ্গে চরমপন্থী হিন্দু মহাসভার যোগাযোগ ছিল। হিন্দু মহাসভা পাকিস্তানিদের অর্থ সাহায্য দেবার প্রস্তাব করে ভারতকে দুর্বল করার জন্য গান্ধীকে দোষারোপ করে। নাথুরাম গডসে এবং  তার সহায়তাকারি নারায়ণ আপতেকে পরবর্তীতে আইনের আওতায় এনে আদালতে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ভারতের আদালত নাথুরাম গডসে এবং তার সহায়তাকারী নারায়ণ আপতেকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। ১৯৪৯ সালের ১৪ নভেম্বর তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। অপরাধীদের দায়মুক্তি প্রদানের প্রশ্নই উঠেনি।

১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর, ভারতের তদনীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। ইন্দিরা গান্ধীর দুই শিখ দেহরক্ষী  সৎবন্ত সিং ও বিয়ন্ত সিং অপারেশন ব্লু স্টার চলাকালীন ‘স্বর্ণমন্দির’ নামে পরিচিত শিখদের সর্বোচ্চ তীর্থ হরমন্দির সাহিবে সেনা অভিযানের প্রতিশোধকল্পে তাকে হত্যা করে। বিয়ন্ত সিং ঘটনাস্থলেই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অন্য দেহরক্ষী দ্বারা নিহত হন। অতঃপর, ইন্দিরা হত্যার তদন্তের জন্য গঠন করা হয় ‘জাস্টিস ঠক্কর কমিশন।‘ এই কমিশন ষড়যন্ত্রের জন্য পৃথক তদন্তের পরামর্শও দেয়। আদালতে সৎবন্ত সিং ও ষড়যন্ত্রকারী কেহার সিং মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। ১৯৮৯ সালের ৬ জানুয়ারি তাদের দণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়। সুতরাং ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে আমরা দেখেছি; অপরাধীদের দায়মুক্তি দেয়া হয়নি।

ভারতের সপ্তম প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ১৯৯১ সালের ২১ মে দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু  রাজ্যের শ্রীপেরামবুদুরে এক আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণে নিহত হন। বিস্ফোরণে রাজীব গান্ধী ছাড়াও আরও ১৪ জন নিহত হয়েছিলেন। রাজীব গান্ধীকে হত্যা করেন তেনমোঝি রাজারত্নম নামে লিবারেশন টাইগার্স অফ  তামিল ইলম বা এলটিটিই-এর এক নারী সদস্য। এই হত্যাকাণ্ডের পিছনে ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব উদঘাটনের জন্য ভারত দুটি তদন্ত কমিশন গঠন করে। রাজীব গান্ধী হত্যা মামলা শুরু হয়েছিল টাডা আইনের অধীনে। চেন্নাই-এ গঠিত বিশেষ টাডা আদালত মোট ২৬ জনের মৃত্যুদণ্ড দেয়। সুপ্রিম কোর্টে আবেদনের ভিত্তিতে চার জনের মৃত্যুদণ্ড হয়। অন্যান্যরা বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড ভোগ করেন। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে অভিযুক্তদের চার জনের মৃত্যুদণ্ড ও বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। আবারও দেখতে পেলাম রাজীব গান্ধী হত্যাকাণ্ডে কোনো অপরাধীকে ছাড় দেয়া হয়নি।

পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডির কোম্পানিবাগে এক জনসভায় বক্তৃতাকালে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। আততায়ীকে সভার মধ্যেই পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। ঘটনার পরপরই পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, হত্যাকারী আফগান নাগরিক, তার নাম সাইদ আকবর, আর ক্ষুব্ধ জনতার হাতে তার মৃত্যু ঘটেছে। তবে লিয়াকত হত্যাকাণ্ড তদন্তের জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। লাহোর হাইকোর্টে একটি মামলাও পরিচালনা করা হয়। তবে গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র ও দলিলের অভাবে মামলাটি বেশিদূর এগোতে পারেনি। তারপরও বলব, লিয়াকত হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল অপরাধীদের দায়মুক্তি দেয়ার ধৃষ্টতা দেখাতে যায়নি।

পাকিস্তানের ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক শীর্ষ সারির বেশ কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা ও দুইজন মার্কিন কূটনীতিবিদসহ ১৯৮৮ সালের ১৭ আগস্ট তারিখে বাহাওয়ালপুরে রহস্যজনক বিমান সংঘর্ষে নিহত হন। তার এই রহস্যজনক মৃত্যুর পর পাকিস্তান এবং যুক্তরাষ্ট্র আলাদা আলাদাভাবে ঘটনার তদন্ত করে। জিয়াউল হক হত্যাকাণ্ডের দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক তদন্তে পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়নি।

পাকিস্তানের আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো ২০০৭ সালের ২৭ ডিসেম্বরে রাওয়ালপিন্ডিতে  আত্মঘাতী হামলায় নিহত হন। এই ঘটনার বিচারের লক্ষ্যে পাকিস্তানের আদালতে মামলা গড়ায়। এটা সত্যি যে, দুবাইয়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকায় মুশাররফের বিরুদ্ধে মামলা স্থগিত রয়েছে। তবে বেনজিরের ছেলে বিলাওয়াল ভুট্টো মুশাররফের বক্তব্য খারিজ করে দিয়েছেন। মুশাররফের বিরুদ্ধে আইনগত প্রক্রিয়া আটকে থাকার এ সময়ে বাকিদের মামলা থেকে খালাস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আদালতে কোনো কিছুই প্রমাণিত হয়নি। বিচারক বলেছেন, যে প্রক্রিয়ায় তথ্য-প্রমাণ জোগাড় এবং উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে অভিযুক্তদের খালাস দিতে হচ্ছে। তবে আপিলের নিষ্পত্তি না হওয়ায় অভিযুক্ত পাঁচ জন এখনো কারাগারে আছে।

বেনজির হত্যাকাণ্ড মামলা এখনও চলমান একটি প্রক্রিয়া। বেনজিরের হত্যাকারী বিলালের সঙ্গে থাকা আরেকজন আত্মঘাতী হামলাকারী ইকরামুল্লাহকে মৃত বলে দাবি করা হয়ে আসলেও বেশ কিছু সূত্রমতে তিনি এখনও জীবিত। বিলাল হামলা চালাতে সক্ষম হয়ে যাওয়ায় ইকরামুল্লাহকে আর কিছু করতে হয়নি। তিনি অক্ষত অবস্থাতেই পালিয়ে যান। কিন্তু গত বছর আগস্টে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের প্রকাশিত ২৮ পাতার একটি মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসীর তালিকায় ৯ নম্বরে দেখা গেছে ইকরামুল্লাহর নাম। বিবিসি’র তথ্যমতে, ইকরামুল্লাহ এখন আফগানিস্তানে আছেন। সেখানে মাঝারি পর্যায়ের পাকিস্তানি তালেবান কমান্ডার হিসাবে কাজ করছেন তিনি। বেনজির ভুট্টো হত্যাকাণ্ডে এখন পর্যন্ত যে দু'জন ব্যক্তির সাজা হয়েছে তারা হচ্ছেন দুই পুলিশ কর্মকর্তা। দায়িত্বে অবহেলার কারণে তাদের সাজা দিয়েছে আদালত। তাহলে দেখতে পাচ্ছি বেনজির হত্যাকাণ্ড মামলা দীর্ঘসূত্রতার বেড়াজালে জড়িয়ে থাকলে ও অপরাধীদের দায়মুক্তি দেয়ার কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।

এবার আসা যাক শ্রীলঙ্কাতে সংঘটিত রাজনৈতিক হত্যার দিকে। ১৯৫৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর তারিখে শ্রীলঙ্কার চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী সলোমান বন্দরনায়েক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী কর্তৃক নিহত হন। ১৯৫৯ সালেই কলম্বোর চিফ ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সাতজনের বিরূদ্ধে অভিযোগ এনে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু করা হয়। ১৯৬১ সালে শ্রীলঙ্কার সুপ্রিম কোর্ট বুদ্ধরক্ষিত থেরো, এইচ পি জয়বর্ধন এবং সোমারামা থেরো; এই তিন জনকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। পরবর্তীতে এই তিনজনই শ্রীলঙ্কার কোর্ট অব ক্রিমিনাল আপিলে আপিল দায়ের করেন। আপিল খারিজ হয়ে যায় তবে শ্রীলঙ্কার কোর্ট অব ক্রিমিনাল আপিল বুদ্ধরক্ষিত থেরো এবং এইচ পি জয়বর্ধন কে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দেয় কিন্তু সোমারামা থেরোর মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। ১৯৬২ সালের ৬ জুন তারিখে সোমারামা থেরোর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

১৯৮৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কলম্বোর উপকণ্ঠে শ্রীলঙ্কার বিখ্যাত রাজনীতিবিদ কুমারাতুঙ্গাকে তার বাড়ির বাইরে মাথায় গুলি করে হত্যা করেছিল লিওনেল রানাসিংহ ওরফে গামিনী। শ্রীলঙ্কার ফৌজদারি তদন্ত বিভাগের জিজ্ঞাসাবাদে রানাসিংহ এই হত্যার কথা স্বীকারও করে নেন। এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে রাষ্ট্রপতি কমিশনের একটি তদন্ত প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয় যেখানে কুমারাতুঙ্গাকে হত্যায় জড়িত সবাইকে চিহ্নিত করা হয়। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো একটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পর প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। অপরাধীকে দায়মুক্তি দেয়া হয়নি।

শ্রীলঙ্কার তৃতীয় রাষ্ট্রপতি রানাসিংহে প্রেমাদাসা ১৯৯৩ সালের ১ মে তারিখে মে দিবসের শোভাযাত্রা  অনুষ্ঠানে এলটিটিই পরিচালিত আত্মঘাতি বোমা হামলায় নিহত হন। যদিও ঘটনা ঘটার দেড় ঘণ্টার মধ্যে বোমা হামলার জায়গাটি ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করার ফলে দরকারি আলামত নষ্ট করার অভিযোগ তোলা হয়, তবুও এটা সত্য যে এই দেড় ঘণ্টার মধ্যেই  পুলিশ এবং ম্যাজিস্ট্রেট জায়গাটি পরিদর্শন করে ফেলে। আর শুধু তাই-ই নয়, যদিও আত্মঘাতী হামলাকারী কুলাভিরাসিঙ্গাম ভিরাকুমার ওরফে বাবু ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করে তথাপি প্রেমাদাসা  হত্যাকাণ্ডের পুলিশি তদন্ত দীর্ঘ সময় ধরে চলে। সংশ্লিষ্ট সবাইকেই পর্যায়ক্রমে আইনের আওতায় আনা হয়; অপরাধীদের দায়মুক্তি দেবার কোনো বিষয় কখনও উঠে আসেনি।

ভূটান রাষ্ট্রটিকে আপাতদৃষ্টিতে শান্তিপূর্ণ মনে হলেও এই দেশটিতেও ঘটেছে রাজনৈতিক হত্যা। কিন্তু সেই রাজনৈতিক হত্যার জন্য কোনো অপরাধীকে দায়মুক্তি দেয়া হয়নি। বরং আইনের আওতায় এনে তাদের বিচার করা হয়েছে। ১৯৬৪ সালের ৬ এপ্রিল হত্যা করা হয় ভুটানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জিগমে পালদেন দোরজিকে। হত্যাকাণ্ড পরবর্তী সময়ে এ ঘটনার তদন্ত ও বিচার শুরু করা হয়। আসামিদের বেশিরভাগই ছিলেন ভুটানের সামরিক বাহিনীর সদস্য যাদের ওপর আদালতের বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দণ্ড কার্যকর করা হয়। আর শুধু তাই-নয় ভুটানের তৎকালীন সামরিক প্রধান নামগিয়াল বাহাদুরকে জিগমে পালদেন দোরজিকে হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতার কারণে মৃত্যুদণ্ডও দেয়া হয়।

২০১২ সালের অক্টোবরের ২ তারিখে মালদ্বীপের রাজনীতিবিদ ও তৎকালীন সংসদ সদস্য ড. আফরাশিম আলীকে তার নিজ বাসভবনে আততায়ীরা হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত মালদ্বীপের ইতিহাসে দীর্ঘ সময় ধরে চলা অন্যতম তদন্তের একটি। তদন্তের স্বচ্ছতা বজায় রাখার এবং অগ্রগতি অবহিত করবার জন্য জাতির সামনে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংও করা হতো। ২০১৩ সালের ২৩ মে তারিখে হুসেন হুমাম নামের একজন ড. আফরাশিম আলীকে হত্যার দায় স্বীকার করেন। পরবর্তীতে আদালতের রায়ে হুমামকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। মালদ্বীপের সুপ্রিম কোর্টেও হুমামের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। শুধু তাই নয়, মালদ্বীপ সরকার একটি আলাদা প্রেসিডেন্সিয়াল কমিশন করে ড. আফরাশিম আলী হত্যার একটি বিস্তারিত তদন্ত প্রতিবেদনও প্রকাশ করে।

২০০১ সালের ১ জুন নেপালের নারায়ণহিতি রাজপ্রাসাদে সংঘটিত হয় এক হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ড। সেদিন নেপালের তৎকালীন রাজা বীর বিক্রম শাহ, রাণী ঐশ্বর্য রাজ্য লক্ষ্মী দেবীসহ নেপালি রাজ পরিবারের মোট নয় জন সদস্যকে একই রাতে একই স্থানে হত্যা করেন রাজপুত্র দীপেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ। যদিও হত্যাটি রাজনৈতিক, নাকি পারিবারিক সেটি নিয়ে এখনও নিশ্চিত বলা যায় না। তবুও এটা মেনে নিতে হবে যে হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হওয়ার পর পরই উচ্চ পর্যায়ের দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সদস্যরা ছিলেন, নেপালের সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি কেশব প্রসাদ উপাধ্যায় এবং নেপালী লোকসভার তৎকালীন স্পিকার তারানাথ রানাভাত। কমিটি লম্বা সময় ধরে তদন্ত করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে রাজকুমার দীপেন্দ্র বীর বিক্রম শাহই এই হত্যা সংঘটিত করেছেন।

দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্রে সংঘটিত এতগুলো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের উদাহরণ দেয়ার উদ্দেশ্য হলো, যেখানেই এই ধরনের রাজনৈতিক হত্যা সংঘটিত হয়েছে সেখানেই তার বিচার বা তদন্ত করা হয়েছে। কোথাও অপরাধীদের দায়মুক্তি দেয়া হয়নি। এই যে ‘রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদের’  নগ্ন উল্লাস – তার বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি রাষ্ট্র। গণতান্ত্রিক সমাজ রক্ষায় ও এই সব জঘন্য ধারাবাহিক রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদের সমাপ্তি ঘটাতে, প্রকৃত অপরাধীদের ও তাদের মদদদাতাদের আইনের আওতায় এনে বিচার করা অপরিহার্য বলেই মনে করেছে রাষ্ট্র। বাংলাদেশে কিন্তু আমরা দেখেছি এক উল্টো চিত্র।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ক্ষমতা দখল করে নেয় সেনাসমর্থিত খোন্দকার মোশতাক সরকার। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাত্র নয় দিনের মাথায় অর্থাৎ ২৪ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান থাকাকালীন ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর অঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন।

ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশটিতে দুটি অংশ রয়েছে। প্রথম অংশে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। দ্বিতীয় অংশে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।

একটি সভ্য দেশে এমন আইন প্রণয়ন করা কি সম্ভব? আইনের শাসনের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা। সমাজে অপরাধ হলে, বিচার হতেই হবে। আর তা না হলে সেই সমাজ অপরাধের চোরাগলিতে ডুবে যায়। কিন্তু এই যে ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ এটা কোনো সভ্য দেশের আইন হতে পারে না। অপরাধীকে অপরাধের দায়ভার থেকে মুক্তি দেয়া মানেই হলো সমাজে আরও অপরাধ সংঘটনকে উৎসাহিত করা, যেটা কখনই কাম্য নয়। আর আমরা ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ঠিক এই কাজটি-ই করেছি। রাজনৈতিক হত্যা সংঘটিত হওয়ার পর তার বিচার তো দূরের কথা, বরং আইন করে তার তদন্ত ও বিচার চিরতরে বন্ধ করে দেয়ার ব্যবস্থা করেছি। এই যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি তা থেকে মুক্তি পেতে আমাদের বহু বছর লেগেছে। এমন কলঙ্কিত অধ্যায়ের দৃষ্টান্ত বিশ্বে সত্যিই বিরল।

এরপর ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী গৃহীত হয়। পঞ্চম সংশোধনীটি নিজে কোনো আইনের সংশোধনী নয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে আইনি বৈধতা দান করা হয়।

পঞ্চম সংশোধনীর মূল কথা হলো, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারিখসহ ওই দিন থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল তারিখ পর্যন্ত (ওই দিনসহ) সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের যে কোনো ঘোষণা বা আদেশ বলে সম্পাদিত সংবিধানের সব সংশোধনী, সংযুক্তি, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন ও বিলুপ্তি বৈধভাবে সম্পাদিত বলে বিবেচিত হবে এবং কোনো কারণেই কোনো আদালত বা ট্রাইব্যুনালে এসবের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না। এরূপে, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে ‘সংবিধান (পঞ্চম সংশোধনী) আইন, ১৯৭৯’র মাধ্যমে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে বৈধতা দেওয়ায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যার সঙ্গে জড়িত অপরাধীরা পাকাপোক্তভাবে দায়মুক্তি পেয়ে যায়।

কেন পাকাপোক্তভাবে দায়মুক্তির কথাটি বললাম তার যথেষ্ট কারণ আছে। ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল সামরিক আইন প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। ফলে ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে অঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদের জারি করা ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশটি তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। অতএব, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের খুনিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে বাধা ছিল না। কিন্তু ‘সংবিধান (পঞ্চম সংশোধনী) আইন, ১৯৭৯’র ক্ষমতাবলে ভবিষ্যতে কেউ যাতে ১৫ আগস্ট খুনীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিতে পারে সে ব্যবস্থাটিকে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে’ পরিণত করা হলো। একইসঙ্গে এটাও বোঝানো হল যে, যেহেতু এটি সংবিধানের অংশ হয়ে গেছে এটি আর পরিবর্তন করা যাবে না। আর এই দোহাই দিয়েই জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরেও বিচারপতি আবদুস সাত্তার, এইচ এম এরশাদ এবং ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এলেও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বাতিল বা রহিত করেননি। ফলে দায়মুক্তি পেয়ে খুনিরা ১৫ আগস্টের হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা প্রকাশ্যেই বলে বেড়াত।

১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬– এক সুদীর্ঘ ২১ বছরের পথ পাড়ি দিয়ে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে। অতঃপর, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের আইনগত দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব আমিন উল্লাহর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি তার রিপোর্টে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের জন্য সংবিধান সংশোধনের কোনো প্রয়োজন নেই। কেননা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মতোই প্রায় ১৬টি আইন পঞ্চম সংশোধনীর অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা পরবর্তীকালে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েই সংসদে বাতিল করা হয়েছে। সুতরাং, কমিটির মতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটিও একই রকমভাবে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েই সংসদে বাতিল করা সম্ভব।

কমিটির এই রিপোর্ট আইন কমিশনের মতামতের জন্য পাঠানো হলে সাবেক প্রধান বিচারপতি এফ কে এম মুনীরের নেতৃত্বাধীন আইন কমিশনও তা সমর্থন করে। এরপর তৎকালীন আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বিল বাতিলের জন্য 'দি ইনডেমনিটি রিপিল অ্যাক্ট-১৯৯৬' নামে একটি বিল সংসদে উত্থাপন করেন। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর বাংলাদেশ সংসদে মানবতা ও সভ্যতাবিরোধী কলঙ্কিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল আইন প্রণয়ন করা হয়। ঘোচানো হয় ২১ বছরের জাতীয় কলঙ্ক।

আজ সেই কলঙ্কমুক্তির দিন। অন্ধকার থেকে আলোর দিকে পদযাত্রার দিন। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দিন।

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

এ বিভাগের আরো খবর